রাহুমুক্ত হওয়ার পর নানামুখি চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে এগুচ্ছে রাজশাহী প্রেস ক্লাব। ২৬ আগস্ট নির্বাহী কমিটি তলবি সভার মাধ্যমে আগের কমিটি বিলুপ্ত করে। ঐ সভায় ৭ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হওয়ার পর পরই শুরু হয় এই চ্যালেঞ্জ।
এই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে আহ্বায়ক কমিটিতে নতুন করে দু'জনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই নয়া আহ্বায়ক কমিটি প্রথমবারের মত গত ১৬ সেপ্টেম্বর পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে নগরীর একটি রেস্টুরেন্টে আলোচনা সভার আয়োজন করে। সভা শেষে কিছু বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যেই অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে। যা সভায় আগত মান্যবর অতিথিদেরকেও আহত করে।
এ ঘটনায় সাংবাদিকরাও বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়ে। আকাংখা যেন অঙ্কুরেই বিনষ্ট না হয়,সেজন্য অনেক নতজানু চেষ্টায় বিষয়টি প্রশমিত করা হয়। এঘটনা প্রেস ক্লাবের জন্য একটি সতর্ক সঙ্কেত বলে অভিজ্ঞজনরা মনে করেন। রাহুমুক্তির পরের রাজশাহী প্রেসক্লাবের চেহারাটা কেমন হবে-এ নিয়ে রাজশাহীর সাংবাদিকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বেশিরভাগ সাংবাদিকরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন,পরিবেশ পরিস্থিতি খুব একটা শুভ মনে হচ্ছেনা। যে লাউ,সেই কদুই হয় কিনা!
সদস্য হওয়ার অভিপ্রায়ে রাজশাহী প্রেস ক্লাবে এখন রমরমা অবস্থা বিরাজ করছে। বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো আসছে আবেদন পত্র। এই জোয়ারে কারা ভেসে যাবে,আর কারা ফসল ঘরে তুলবে-এ নিয়ে চলছে নানা কৌশল, চুলচেরা বিশ্লেষণ, গ্রুপিং, জল্পনা-কল্পনা। আবেদন ফরম জমা দেবার সর্বশেষ তারিখ ছিল ২৭ সেপ্টেম্বর।কিন্তু একটি গ্রুপের চাপে জরুরি সভা করে জমা দেবার তারিখ পুনরায় বৃদ্ধি করা হয় ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত। এসব নানা অসম ঘটনায় নিরবে নিভৃতে এখানে কয়েকটি বলয়ের সৃষ্টি হচ্ছে। এই বলয় শেষ পর্যন্ত কাকে কোথায় নিয়ে যাবে, কে জানে!
২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শতাধিক সাংবাদিকের আবেদন জমা পড়েছে বলে জানা গেছে। নগরীতে গড়ে ওঠা অন্যান্য প্রেস ক্লাব থেকেও অনেক তরুণ সাংবাদিক আবেদন করেছেন এবং করছেন। ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত আরো বহুসংখ্যক জমা পড়বে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বিশিষ্ট স্বত্বাধিকারী কিছুসংখ্যক মূলধারার সাংবাদিক এসব তরুণ সাংবাদিকদের কীভাবে মূল্যায়ন করবেন, সেটাও একটা বিচার্য বিষয় বলে গুঞ্জন রয়েছে। এদের মধ্যে কতজনকে, কোন কোন যোগ্যতার ভিত্তিতে, কোন দৃষ্টিকোণ থেকে সদস্য নির্বাচিত করা হবে, তা নির্ধারণ করবে সংশ্লিষ্ট কমিটি।তবে যেটাই হোক, পুরনো ভুলের যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সেটাই কামনা করে হিতাকাঙ্ক্ষী মহল।
ক্লাবের সদস্য পদে আবেদনের যোগ্য হওয়ার জন্য কয়েকটি মানদণ্ড নির্ধারণ করে দিয়েছে কমিটি।যেমন, গণমাধ্যমে ন্যূনতম ৫ বছরের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতার প্রমাণপত্র, সর্বশেষ শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদের সত্যায়িত কপি, বর্তমানে কর্মরত গণমাধ্যমের নিয়োগপত্র/পরিচয়পত্র ইত্যাদি দৃশ্যমান কাগজপত্র আবেদনের সাথে সংযুক্ত করার কথা বলা আছে। আর অদৃশ্য যেসব ব্যাপার-স্যাপার বিবেচনা করা হবে, সেগুলোই প্রেসক্লাবকে আরেকটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।সমস্ত শর্ত পূরণ করে প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জনের পরও পক্ষপাতমূলক এবং গোষ্ঠীগত স্বার্থ বজায় রাখার কারণে প্রেস ক্লাবগুলোতে ভাঙনের সৃষ্টি হয় এবং প্রতিপক্ষ গ্রুপ গড়ে ওঠে। যা অতীতে সকলে দেখে এসেছে। অতীতের ভুল থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে সংস্কার কখনো সম্ভব না।
আমরা যে নতুন বাংলাদেশের কথা বলছি, যে রূপান্তরের কথা বলছি, যে বদলের কথা বলছি- দায়বদ্ধতার সেই জায়গা থেকে নতুন বাংলাদেশে আমরা নতুন প্রেস ক্লাব গড়ে তোলার চেষ্টা করি। কেউ নিজেদের স্বার্থের কথা না ভেবে,বৃহত্তর সাংবাদিক সমাজের কল্যাণের জন্য রাজশাহী প্রেস ক্লাবকে সংস্কার করে নতুন সুস্থ সার্বজনীন একটি ক্লাব গড়ে তুলি।
জানিনা, এখানে সদস্য নির্বাচনে কোন কোন পদ্ধতি কিংবা রীতি অনুসরণ করা হবে। তবে যে পদ্ধতিই অনুসরণ করা হোকনা কেন, পূর্বের সিস্টেমকে ভাঙতে না পারলে, আকাঙ্ক্ষিত প্রেস ক্লাব পাওয়া সুদূরপরাহত। সুস্থ মনের সাংবাদিকদের জন্য বড়ই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করবে।ক্লাবকে কারা নিয়ন্ত্রণে রাখবে-এ নিয়ে চলছে ত্রিমুখী চতুর্মুখী আয়োজন।পরিবেশ বিশ্লেষণে জানা গেছে,এখানে কয়েকটি ফ্যাক্টর কাজ করছে।প্রথমত,কোন কোন সাংবাদিক আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে সুবিধাভোগী ছিলেন,কারা আর্থিক সুবিধাসহ প্লট, চাকরি এবং অন্যান্য সুবিধা আদায় করে নিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত, এমন কয়েকজন সাংবাদিক আছেন, যাদের গায়ে অনেক আগে জামায়াত শিবির কিংবা বিএনপির ট্যাগ ছিল, কিন্তু গত ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদ শাসনামলে এরা সাবেক মেয়র খায়রুজ্জামান লিটনসহ অন্যান্য সংসদ সদস্য, মেয়র পত্নী, বিএমডিএ'র সাবেক চেয়ারম্যান এবং বড় বড় আওয়ামী নেতাদের অত্যন্ত প্রিয়ভাজন এবং কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। তারা এখন ভোল পাল্টিয়ে সরব হয়েছেন বলে অনেকের অভিযোগ। তাদের ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে- এগুলোও একটি ফ্যাক্টর হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
তৃতীয়ত, সাংবাদিকদের আরেকটি গ্রুপ আছে নির্ভেজাল বিএনপি এবং জামায়তের সমর্থক। তারাও স্ব স্ব ক্ষেত্রে সক্রিয়। অন্যদিকে সরিয়ে দেওয়া গ্রুপ চুপচাপ বসে থাকবে,সেটা ভাবাও বোকামি।তারা যদি সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করে,তবে আইনের নানা ফাঁক ফোকর যে তারা খোঁজার চেষ্টা করবেনা,সেটাও বলা মুশকিল। বর্তমান কমিটিকে এসব বিষয় মাথায় নিয়েই সদস্য নির্বাচনের দিকে মনোনিবেশ করতে হচ্ছে।
ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে সরব কণ্ঠের কয়েকজন সাংবাদিকের দ্বৈত চরিত্রের স্ট্যাটাস। সেইসব স্ট্যাটাস বর্তমানে নাকি তাদের ফেসবুকে আর দেখা যাচ্ছেনা। সাবেক মেয়র লিটন এবং তার পত্নী শাহীন আকতার রেনির প্রতি, শেখ মুজিবুরের প্রতি তাদের আবেগীয় শ্রদ্ধা আর তোষামোদপূর্ণ সব স্ট্যাটাস, সেলফিসহ ভারত প্রীতির নানা প্রমাণ ডিলিট করার আগেই নাকি কেউ কেউ স্ক্রিনশট করে রেখেছে বলে ফেসবুকে অনেকের পোস্টে উল্লেখ করেছে। অর্থাৎ নিজেকে আওয়ামী ঘরানার বলে প্রচেষ্টাকারি ঐসব সাংবাদিক তাদের স্ট্যাটাসগুলো ডিলিট করে এখন নাকি ভোল পাল্টিয়েছে। এরা যদি এই প্রেস ক্লাবে ঢুকতে চান, তবে কট্টরপন্থীরা তাদেরকে প্রতিহত করার চেষ্টা করবে, এধরনের আভাসও ফেসবুকের স্ট্যাটাসে দেখা যাচ্ছে।
আরেকটি ফ্যাক্টর, রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কিছু সাংবাদিকের একপেশে চিন্তাভাবনা। শিক্ষাগত যোগ্যতাও একটি ফ্যাক্টর হবে বলে মনে হচ্ছে। কারণ,সদস্য হওয়ার শর্তে বলা আছে, সর্বশেষ শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ লাগবে। সেখানে সুনির্দিষ্টভাবে শিক্ষাগত যোগ্যতার কোনো উল্লেখ নেই। এতেই বুঝা যাচ্ছে,এখানে কোন কিন্তু আছে। কারণ,অনেক সাংবাদিকের এমনকি নেতৃস্থানীয় কারো কারো শিক্ষাগত যোগ্যতা অনেক কম আছে। এদের নিয়েও দ্বিধাদ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে বলে গুঞ্জন রয়েছে।
সরকারি নিবন্ধিত মিডিয়া লিস্টভুক্ত এবং সরকারি কাগজপত্রে প্রচার সংখ্যাও মোটামুটি ভাল অথচ আন্ডারগ্রাউন্ড বলে খ্যাত, এমন পত্রিকার কিছু সাংবাদিক সব শর্ত পূরণ করে আবেদন ফরম জমাও দিয়েছেন,তাদের ক্ষেত্রে কী করা হবে-এ নিয়েও আলোচনা আছে।মূলধারার সাংবাদিক অথচ তাদের নামে সব গুরুতর অভিযোগ আছে, এদের নিয়ে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে- এই ধরনের নানা চ্যালেঞ্জ নিয়ে এগুতে হচ্ছে রাজশাহী প্রেস ক্লাবকে।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের বিজয়ের পর রাহুমুক্ত হয় রাজশাহী প্রেস ক্লাব। বর্তমানে টালমাটাল অবস্থায় অভিভাবক শূন্যতায় ভুগছে ক্লাবটি। রাজশাহীবাসির আশা ভরসার স্থল এই ক্লাব আজ জটিল অবস্থার মধ্যে রয়েছে। এই দুরবস্থা থেকে ক্লাবকে প্রকৃত অর্থে উজ্জীবিত করতে হলে যেসব সিনিয়র সাংবাদিকরা ক্লাব থেকে দূরে সরে আছেন অথবা বিকল্প হিসেবে অন্য কোথাও স্থান নিয়েছেন, সেইসব ঘরের ছেলেদের ঘরে ফিরে আসা জরুরি। রাজশাহী প্রেসক্লাবের যে সব সাংবাদিক ভাইয়েরা মনোকষ্ট নিয়ে অথবা নানা অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘদিন দূরে সরে আছেন, তাদের আজ আপন ঘরে ফেরার সময় এসেছে। আপনারা ফিরে আসুন, রাজশাহীর ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারক বাহক সুপ্রাচীন রাজশাহী প্রেস ক্লাবের ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনার ব্রতে অংশ নিয়ে নিজের ঘরকে পরিচ্ছন্ন করুন। অভিভাবকত্বের হাল ধরে নতুনদের পথ দেখান।
সংস্কারের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক উপায়ে সুসংগঠিত, সুশৃংখল একটি কমিটি দ্বারা এই ক্লাবকে সকলের আকাংখিত প্রেস ক্লাব গড়ে তুলতে প্রকৃত সাংবাদিকদের অবদান রাখা প্রয়োজন । কোন অপশক্তি কিংবা সুযোগসন্ধানী অসৎ, নামধারী সাংবাদিকগোষ্ঠী কৌশলে কিংবা পেশিশক্তির দ্বারা যেন ক্লাবের নিয়ন্ত্রণ নিতে না পারে, সেদিকে তীক্ষ্ণ নজরদারি রাখতে হবে। ইতিহাসের এক টার্নিং পয়েন্টে এই প্রেস ক্লাবকে সংস্কার করার সুযোগ এসেছে। ২৪'র বিশ্ব নাড়া দেওয়া গণ-অভ্যুত্থানের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় সংস্কারের একটি বড় অনুষঙ্গ সাংবাদিকদের পীঠস্থান প্রেস ক্লাব সংস্কারের এইতো সুবর্ণ সুযোগ। এই সুযোগকে কাজে লাগানোর দায়-দায়িত্ব গ্রহণকারী ক্লাবের বর্তমান কমিটি নিশ্চয় বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করবেন।
নির্বাহী কমিটি এবং আহ্বায়ক কমিটির স্কন্ধে এখন বিশাল দায়িত্ব। তাদের ভুলে, অবহেলায় কিংবা অযোগ্যতার কারণে যদি ফের প্রেস ক্লাবকে ভোগান্তি পোহাতে হয়, তবে সাংবাদিক সমাজের সামনে তাদের জবাবদিহি করতে হবে। আমরা যেন পূর্বের ভুলের পুনরাবৃত্তি না করি। সেই পুরনো পথে যেন আমরা না হাঁটি। আমরা যে নতুন বাংলাদেশের কথা বলছি, যে রূপান্তরের কথা বলছি, যে বদলের কথা বলছি- দায়বদ্ধতার সেই জায়গা থেকে নতুন বাংলাদেশে আমরা নতুন প্রেস ক্লাব গড়ে তোলার চেষ্টা করি। কেউ নিজেদের স্বার্থের কথা না ভেবে,বৃহত্তর সাংবাদিক সমাজের কল্যাণের জন্য রাজশাহী প্রেস ক্লাবকে সংস্কার করে নতুন সুস্থ সার্বজনীন একটি ক্লাব গড়ে তুলি। এই গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রয়েছে প্রেস ক্লাবের নয়া কমিটির। আশা করি,তারা যেন নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি না করে নিরপেক্ষ এবং পক্ষপাতহীনভাবে সদস্য নির্ধারিত করে আগামি তিন মাসের মধ্য গণতান্ত্রিক উপায়ে একটি স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি দক্ষ ও শক্তিশালী কমিটি উপহার দিবে। এই কমিটিই রাজশাহী প্রেস ক্লাবকে এক অনন্য মাত্রায় পৌঁছে দিবে বলে বিশ্বাস করি।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, রাজশাহী এবং সভাপতি, সার্ক জার্নালিস্ট ফোরাম, রাজশাহী বিভাগ।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Matribhumir Khobor